রবিবার, ২ জানুয়ারী, ২০১১

আরুষী হত্যা রহস্য এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থা

অবশেষে দুই বছর পর তদন্ত কার্‍্যে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়ে  সিবিআই ঘোষনা করল যে
তারা আরূষী হত্যা মামলায় ইতি টানছে। এই সাড়া জাগানো হত্যা রহস্যটি গত দুই বছর ধরে দেশের প্রতিটি সংবামা
ধ্যমের শিরোণামে থেকেছে কারণ যেভাবে এর ঘটনাক্রম নিত্যনতুন মোড় নিয়েছে তা রীতিমত শিহরণ জাগানো এবং চাঞ্চল্যকর। ইতিপূর্বে এই প্রকৃতির ঘটনা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের শিরোণামে জায়গা পেত না হয়তো বা “টুকরো খবর” হয়ে রয়ে যেত। সে যাই হোক, বর্তমান আলোচণার বিষয়বস্তু তা নয়। আমরা আলোচণা করবো হত্যা তদন্ত ব্যর্থ হবার কারণ এবং সম্পর্কীত কিছু সমস্যা


ঘটনার শুরু ২০০৮ এর ১
ই মে যখন নয়ডার উচ্চবিত্ত এলাকা জলবায়ু বিহারে ১৪ বছরের কিশোরী আরুষীকে তার নিজের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রাথমিক অবস্থায় সন্দেহ করা হয় বাড়ির চাকর হেমরাজকে। কিন্তু পরের দিন হেমরাজের মৃতদেহ পাওয়া যায় বাড়ি ছাদে। পুলিশের সন্দেহ ঘুরে যায় বাড়ির অন্য সদস্যদের প্রতি। তদন্তে নেমে পুলিশ প্রমান পায় হত্যা করা হয়েছে মাথায় ভারী কোনো ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এবং পরে অত্যন্ত ধারালো কোনো ছুরি জাতীয় অস্ত্র দিয়ে গলার নলি কেটে দেয়া হয়একই পদ্ধতিতে খুন করা হয় হেমরাজকেও।কিছু দিনের মধ্যেই পুলিশ অভিযোগ করে খুনের পিছনে আছে বাবা রাজেশ তলওয়ার । মোটিভ হিসাবে সামনে আনা হয় অনার কিলিং। পুলিশ সন্দেহ করে রাজেশ তলওয়ার এবং পারিবারিক বন্ধু অনিতা দূরানির মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক আছে যা আরুষী জেনে ফেলেছিল এবং অন্য দিকে, বাড়ির চাকর হেমরাজ ও আরুষীর মধ্যে গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠতা যা রাজেশ তলওয়ারের তীব্র অপছন্দ ছিল। এই কারণেই ঠান্ডা মাথায় মেয়েকে খুন করে মা নূপুর তলওয়ারের সাহায্যে তথ্যপ্রমাণ সরিয়ে ফেলে রাজেশ।
১] উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এবং তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইঃ
প্রাথমিক অবস্থায় ঘটনার তদন্তভার ছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হাতে যারা প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, যা কিনা পরবর্তীকালে ঘটনার তদন্তে হতে পারত অমূল্য প্রমাণ, পূরোপুরি অবহেলা করে। তাছাড়া নয়ডা পুলিশের নামে নাবালিকা আরুষীর চরিত্র কলুষিত করার এবং অবৈধ যোগসাজশের  অভিযোগ ওঠে। এরপর উত্তরপ্রদেশ সরকারের অনুরোধক্রমে তদন্তভার তুলে নেয় সিবিআই। গত দুই বছর তদন্ত করার পর সিবিআই কেস সমাপ্তি রিপোর্ট জমা দিয়েছে নয়ডার আদালতে।

এখন প্রশ্ন হলো, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ যে ভাবে প্রাথমিক তদন্ত করেছে তা অত্যন্ত নিম্ন মানের বললেও খুব কম বলা হয়। কর্তব্য পালনে চূড়ান্ত গাফিলতি এবং অবৈধ যোগসাজশ দুইই একটি রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে মারাত্মক। যদিও এর ফল হিসাবে পুলিশের বেশ কিছু বড়কর্তাকে বদলি করে দেওয়া হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে এই রাজ্যটির আইনশৃঙ্খলার যা হাল তাতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের পুর্নবিচার হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো সিবিআই-এর এই ভাবে বিফল হওয়া আশঙ্কাজনক। না, একথা বলছিনা যে সিবিআইকে যে কোনো রহস্যেরই সমাধান করতে হবে। কারণ সমাধান হওয়া না হওয়া নির্ভর করে আরও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক শর্তের উপর। কিন্তু শুধু যথেষ্ঠ “প্রমাণের অভাব” (যার জন্য সিবিআই সমাপ্তি রিপোর্ট জমা দিয়েছে নয়ডা কোর্টে) প্রমাণ করতেই লেগে গেল দু-দুটি বছর? ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সিবিআই গোটা তদন্তটাকেই বিপথে চালিত করেছে কিনা।
সন্দেহ হয় দেশের শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থাটিতে সত্যি যোগ্য এবং বুদ্ধিমানদের সমাবেশ ঘটেছে তো নাকি শুধুই বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর খবরদারি করার জন্য কিছু হুকুমবরদারকে রাখা হয়েছে?
২] মিডিয়া, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসন
:
অতীতের জেসিকা লাল, প্রিয়দর্শীনি মাট্টু বা নীতিশ কাটারা মামলার মতই এই মামলার পিছনে গণমাধ্যম গুলির ব্যাপক চাপ লক্ষ করা যায়। ইতিমধ্যেই এই [আরুষী মামলা] মামলায় সুপ্রিম কোর্ট গণমাধ্যমগুলির ভুমিকার সমলোচনা করেছেন। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় গণমাধ্যম গুলিতে আলোচনার যে সুফল যে রয়েছে তা পূর্বে উল্লিখিত মামলাগুলির পুর্নবিবেচিত রায়ের মাধ্যমেই টের পাওয়া যায়। আর নিরন্তর প্রশ্নত্তোরের মাধ্যমে আলোচনা না হলে বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে কিভাবে? সমস্যা হল ভারতীয় বিচারব্যবস্থার নিয়ামকরা বর্তমান ব্যবস্থাটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অব্যর্থ ব্যবস্থা বলে গণ্য করে আপন স্বর্গে বাস করেন এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করেননা। তাই একটি পর একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা চোখে পড়ে।
সরকারের আচরণ অবশ্য আরোও আশঙ্কাজনক,
যা ধরা পড়ল
আইনমন্ত্রি বীরাপ্পা মইলির আচরণে। সমাপ্তি রিপোর্ট জমা পড়ার পরেই আইনমন্ত্রি ডেকে পাঠালেন সিবিআই ডিরেক্টরকে এবং ঘটনার পূর্ণতদন্তের আদেশ দিলেন। বোঝা গেলো গনমাধ্যমগুলির চাপ ইতিমধ্যেই আঁচ করতে শুরু করেছেন। অন্যান্য আলোচিত মামলাগুলির ক্ষেত্রেও সরকার পক্ষকে এই ধরণের আচরণ করতে হামেশাই দেখা গেছে । হাবভাব যেন “বাকি সব ঠিক চলছে এইটাতেই একটু গন্ডোগোল হয়ে গেছে।” কিন্ত প্রশ্ন হলো সাধারণ খুন-জখমের মামলাতেও যদি ক্যাবিনেট মন্ত্রিকে হস্তক্ষেপ করে বিবৃতি দিতে হয় তাহলে বুঝতে হবে সমগ্র ব্যবস্থাটাতেই কোথাও গন্ডোগোল হয়ে গেছে এবং তার সত্ত্বর প্রতিকার প্রয়োজন।

মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১০

মুখবন্ধ


ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া ভাব আদানপ্রদান-এর যে-কটা মাধ্যম এবং পদ্ধতি আছে তার মধ্যে বাক্যালাপ বা কথোপকথন, সংবাদপত্র বা বই, বেতার বা রেডিও, দুরদর্শন বা টেলিভশন এবং অধুনা ইন্টারনেট বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

মানুষ যতগুলো উপায়ে ভাব আদান প্রদান করতে জানে তারমধ্যে লিখিত ভাষা সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে । কারণ আমরা যখন পড়ি তখন পূর্ণ মনোনিবেশ করি  এবং চারপাশের প্রভাবক গুলি আমাদের র্স্পশ করতে সাহস করে না। কিন্ত টিভি দেখা বা রেডিও শোনাতে সেই সু্যোগ বেশি। চারপাশের বিক্ষেপগুলি সহজেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে পড়ে।

তাই বলে আহ্লাদিত হবার কারণ নেই কেননা লিখিত ভাষার সেটা একটা দূর্বলতাও বটে। যদি না জ্ঞান চক্ষু উন্মিলিত থাকে লিখিত বক্তব্যের বিচার না করেই  আমরা দ্রুত প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারি। মর্মর্স্পশী কবিতা বা গল্প ঊপন্যাস পড়ে তাই চট করে চোখে জল এসে যায় বা কৌতুকরচনা পড়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। বলাবাহুল্য সে আবেগ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসৃষ্ট আবেগ অপেক্ষা  অনেক বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ  লিখিত ভাষা যেমন শিক্ষিত মানুষের মনে চিন্তার আলোড়ন তুলতে পারে তেমনি অসৎ উদ্দেশ্যে লিখিত রচনা অল্পশিক্ষিতজনকে সহজেই বিপথে চালিত করতে পারে। ইতিহাস তার সাক্ষী।

উপোরোক্ত তিন মাধ্যমের আর একটি সাধারন খামতি উল্লেখএর দাবি রাখে। কোনোটিতেই কিন্তু গ্রহীতা- দর্শক, শ্রোতা বা পড়ুয়া সরাসরি লেখক বা অনুষ্ঠান পরিচালনাকারীর সঙ্গে বাক্যালাপ করতে অক্ষম। এক কথায় বলতে গেলে তিন মাধ্যমই কিন্তু কম বেশি স্বৈরাচারী। পড়ুয়া, দর্শক বা শ্রোতাকে  যুক্তিবাণ হানার সুযোগ দেয় না। সক্রেটিস তাই বোধ হয় বই লেখার আগ্রহ অনুভব করেননি।

তাই কথোপকথনের কোনো বিকল্প ভাবআদানপ্রদান পদ্ধতি নেই। সেখানে যুক্তি বিনা বক্তা শ্রোতাকে প্রভাবিত করতে পারে না।  শ্রোতা যদিও বা বক্তার ব্ক্তব্যকে মেনে নেন, মেনে নেওয়ার আগে তা নিজস্ব যুক্তির কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে দেখে নেন। তাই একে প্রভাব বলা একেবারেই যুক্তিসংগত নয়।
ইন্টারনেট এখানে ভিন্ন চরিত্রে মাধ্যম। একদিকে এ যেমন এক বিশাল তথ্যের আধার অন্য দিকে যুক্তি-তর্কের আদান প্রদান করার অভ্যেসটি এখানে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। ইন্টারনেট ব্যাবহারকারী ইচ্ছা করলেই ভাব আদানপ্রদানে অংশ নিতে পারেন। ব্লগ, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক,ইমেইল এসবেরই নমুনা। তার্কিকদের কাছে বাপ্যারটি বেশ আকর্ষনীয়। চরিত্রের দিক দিয়ে এ অনেকটা কথোপকথন এবং পঠনের মাঝামাঝি।